'সবাক' সাক্ষাতে সায়ান

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান সঙ্গীতের প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে গানের মধ্য দিয়ে নতুন করে ব্যক্তি-সমাজ জীবনের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়ে। সায়ানের জীবনমুখী গান কখনো হয়ে উঠেছে ব্যক্তির একান্ত  মুহূর্তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী অথবা আশ্রয়। আবার এই গানেই তরুণ প্রজন্ম খুঁজে নিয়েছে পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা। কাজ আর শিল্প ভাবনার সাথে সাথে ব্যক্তি সায়ানকে চেনার চেষ্টায় তাঁর সাথে  আলাপচারিতায় মেতেছিলেন জেইউডিও-র তিন বিতার্কিক তাজরীন ইসলাম তন্বী, তাপসী দে প্রাপ্তি এবং সোহানুর রহমান



ফটো ক্রেডিটঃ thedailystar.net


জেইউডিও : প্রথম প্রশ্ন, এই মুহূর্তে গান ছাড়া আর কী কী করছেন? 

সায়ান : গানটাকে সাথে নিয়েই আমার এখন দুই ধরণের এনগেজমেন্ট। একটা হল,মেন্টাল হেলথ। বিকজ গানটা তো আমার ভাষা। আমি আমার ভাষাটাকে ব্যবহার করার জন্য গানটাকে নিয়েই যাচ্ছি। বেসিক্যালি এটা হচ্ছে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ। মন তো একটা অঙ্গ আমাদের। আরো সূক্ষ্ম। মন যদি আপনার মরে যায় তাহলে সুস্থ শরীর নিয়ে আপনি কিভাবে বিছানা থেকে উঠে বসতে হবে বিষয়টাও আপনি করতে পারবেন না। ডিপ্রেশন এমন একটা ব্যাপার। কত কারণে মানুষ আজকে কত বেকার। রিলেশনশীপ তারা হ্যান্ডেল করতে পারেনা। বাবা-মায়ের প্রত্যাশার চাপ।সমাজে এটা সেটা হয়ে দেখাতে হবে। এগুলা আমাদের ছেলে-মেয়েরা কিভাবে সামলাবে যদি নিজের মন তৈরি না থাকে। এই কাজটা আমি করতে ভালোবাসি। 



জেইউডিও : কী ধরনের কাজ করছেন?

সায়ান : ডিপ্রেশনের যেই মেডিকেল সাইটটা, সাইন্সটা যেটা বলল যে ডিপ্রেশন হলে আসলে কি হয়, প্রফেশনালরা বলছে মেডিকেল টার্মে। মানুষ কিন্তু ডাক্তারি কথা,জ্ঞানের কথা বেশি শুনতে চায় না। উনারা বলেন বৈজ্ঞানিক ভাষা দিয়ে। আমি বলি সাধারণ মানুষের ভাষায়। আপনার যদি মন খারাপ হয় আপনি মন খারাপ করাটা শিখেন। এলাউ করেন। বলেন, আমার মন খারাপ। এই মুহুর্তে আমি জীবনে সুখী না। এটা আমার অধিকার। প্রকাশটা করেন। আপনার শরীর ভালো থাকবে। আপনি জীবনে বেঁচে থাকবেন। এই কথাগুলি আমি যত্র তত্র বলি। এজ অফ ভলান্টিয়ার। মেন্টাল হেলথ নিয়ে আমি কথা বলি এটা আমার গরজ। এটা আমার সমাজ, এটা আমার দেশ, এখানকার মানুষ আমার মানুষ। এরা একজন লোক ভালো থাকলে সেটা দেখলে আমার এখানে আরাম লাগে। সেটা আমি প্রফেশনালি করি কিন্তু অনেক জায়গায় আমি আমার তাগিদ থেকে করি আমার গানের পাশাপাশি। বিভিন্ন অর্গানাইজেশন কাজ করে তারা আমাকে ইনভাইট করে নিয়ে যায়। আমি নিজে যেচে গিয়ে ওনাদের সাথে যুক্ত হয়েছি যে আমি এটা নিয়ে কথা বলতে চাই। আমি চাই যে, সবাই এটা নিয়ে কথা বলুক। 


জেইউডিও : আপনার পড়াশোনা তো ছিল হিউম্যান রাইটস নিয়ে? 

সায়ান: হ্যাঁ। হিউম্যান রাইটস নিয়ে পড়াশোনা করেছি আমি। লন্ডনে গিয়েছিলাম ল পড়তে। ওখানেই হিউম্যান রাইটসের ওপর পড়েছি।


জেইউডিও : সেলিব্রেটি হিসেবে সাধারণ মানুষের সাথে কমিউনিকেশনটা কিভাবে ডিল করেন? 

সায়ান : মানুষের সাথে কথা বলে মানুষের সাথে কমিউনিকেট করে আমার যে আনন্দটা হয় এবং মানুষের জীবন থেকে একটা প্রভাব নিয়ে মানুষের জীবন থেকে একটা গল্প বলে মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়ার যে আনন্দ সেটা আমি দূরে বসে বসে অটোগ্রাফ দিয়ে পাবো না।


জেইউডিও : এই জন্যই বোধয় লাইভ প্রোগ্রাম বা কন্সার্ট গুলো বেশি বেশি করেন?

সায়ান : হ্যাঁ, লাইভ প্রোগ্রাম, আমি খুবই কন্টিনিউ প্রোগ্রাম করি। আমার প্রায়োরিটি হচ্ছে কিন্ত আমার মন আমার আনন্দ। আমি চেষ্টা করি এমন কিছু না করতে যেটাতে আমার মন খারাপ হয়। আমি খুবই আমার মনের সাথে যুক্ত। আমার মনে যদি কালি লাগে ওটা নিয়ে আমি আরামে থাকতে পারি না। আমি নিজেকে খুশি করে চলি। আর আমার খুশি টা হলো, মানুষের সাথে কানেক্টেড থাকা। মানুষেই আমার আগ্রহ।


জেইউডিও : আপনার গানের পেছনের গল্পগুলো শ্রোতারা জানতে পারবে কিভাবে? কোন সুযোগ আছে?

সায়ান : যতদিন আমি বেঁচে আছি, যতদিন যে কয়জন লোক আমার গান শুনবে, কথা শুনবে, যাদের আগ্রহ আছে আমার গানের ব্যাপারে, তাদের অনেক প্রশ্ন থাকবে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর শুধু তাদের চিন্তা থেকে যেন না হয় সেজন্য আমি ব্লগ লিখছি- “সায়ানের কথা” এইখানে একটা পর্ব আছে, “জীবনমুখী গান” যা আমার কথা। মানুষদের বলছি যে ওদের স্বাধীনতা আছে বলার কিন্তু আমি কি চিন্তা করি, বেঁচে থাকার সময়টাতে সেটা লিখে যাওয়া আমার দায়িত্ব। তাদের জন্য যারা আমার গানের প্রতি আগ্রহী।


                                                        ফটো ক্রেডিটঃ thedailynewnation.com


জেইউডিও : অনেকেই আপনার গানের সাথে, গানের লিরিকের সাথে নচিকেতা বা সুমনের তুলনা করেন। বলেন যে এই তিনজনের গান অনেক জীবনমুখী। এই ব্যাপারে আপনার কি মতামত? 

সায়ান : নচিকেতা বা সুমনের, প্রত্যেকের সাথে আপনি সাদৃশ্য পাবেন। কারন আমরা যুক্ত। সুমনের গান, অঞ্জন দত্তের গান, নচিকেতার গান শুনে বড় হয়েছি। এইখানে ঢুকে গেছে। বললেই হলো না যে ইনফ্লুয়েন্স নাই। বরং এইটা বলবো, এত বড় বড় মানুষদের যে প্রভাব সেটা ধারণা করাটাই একটা ভাগ্যের ব্যাপার। সেটা ধারণ করেই আপনি নিজে একটা পরিচয় নিয়ে যেন অনুকরণ না করেন, সেটা জরুরী। কারণ তাহলে আপনাকে চিনবে না। আপনার নিজেকে আরেকবার জন্ম দিতে হবে। নাহলে তো আপনি বীজ হয়ে থাকবেন। অনেক মানুষের প্রভাব আমার মধ্যে আছে এবং কিছু কিছু মানুষের প্রভাব আমি নিতে চাই, পারিনি। হ্যাঁ, সবকিছুর পরে বলবো এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমি প্রভাবিত হতে হতে বেঁচে আছি।


জেইউডিও : বর্তমানে বাংলাদেশে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি সেভাবে ডেভেলপ করছে না বা খুব বেশি মানসম্মত কাজ আমরা পাচ্ছি না। সে তুলনায় ভারতের যে বাংলা গান গুলো হচ্ছে, সেখানে গানের যে লিরিক বা সূরে একটা প্রাচুর্য আছে, ওখানে থেকে প্রচুর নতুন নতুন গান হচ্ছে, আমরা শুনছি... আপনার কি মনে হয়? কোন ব্যাপারগুলো এই জিনিসগুলো কে প্রভাবিত করছে? 

সায়ান : আমাদের ইন্ডাস্ট্রি টা যখন শুরু হয়েছে, তখন আমরা পুষ্টি দিতে পারি নি। একটা প্যারালাল গ্রোথ হবে। আপনি ইন্ডিয়াতে দেখেন, যেভাবে তারা ক্ল্যাসিকেল মিউজিক কে তারা কদর করে, ঠিক সেভাবে তারা পপ মিউজিক কে কদর করে এবং তারা সেভাবে ট্রেনিং নেয়,তারা সেভাবে চর্চা টা যেটা যে যা করছে, যে পপ শিল্পী সে শুধু পপ ই গাইছে। কিন্তু সেটাকে সে পেশাদারিত্বের সঙ্গে গাইছে, সেটা শিখছে সেটা নিয়ে সাধনা করছে। আবার যে বাজার টা, সে বাজার টা যেমন পপ মিউজক কে সম্মান করছে, তেমনি ক্ল্যাসিকেল মিউজিকের লোকেরাও ওখানে করে খেতে পারছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি টা ইমম্যাচিউর..


জেইউডিও : কিন্তু এর মধ্যেও তো আমরা দেখেছি যে একটা সময় সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা গান করেছেন...

সায়ান : সেটা ইন্ডিভিজুয়াল। সেটা আপনি খেয়াল করবেন, এ বাংলাদেশ থেকে যত শিল্পী হয়েছে এ পর্যন্ত, সেটা সংস্কৃতিগত কারণে হয় নি, সেটা হয়েছে একটা ইনডিভিজুয়াল মানুষের ট্যালেন্ট কে আপনি চাপা দিতে পারেন নি সে জন্য। কিন্তু একটা দীর্ঘদিনের যে কালচার, আমাদের ফেস্ট হওয়া, ছায়ানটের মত অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান... সবাই সম্মিলিত ভাবে কাজ করা এবং সবগুলি ধারাকে একোমোডেট করা। ফোক মিউজ হোক, ব্যান্ড মিউজিক হোক, সোলো আর্টিস্ট দের কাজ হোক। যারা ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের কাজ করে, তারা হেভি মেটাল কে গালিগালাজ করে, যারা হেভি মেটালের কাজ করে তারা বলে এগুলি কি ভ্যা ভ্যা করে শুধু... আমাদের ম্যাচিউরিটি টা নাই। আমাদের চর্চার জায়গাটা তে পৃষ্ঠপোষকতা নেই। আমি ল' পড়েছি কেন? ফুল টাইম মিউজিক করা খুব কঠিন, লেখা সুর করা, পারফর্মার হিসেবে নিজেকে তৈরি করা, চব্বিশ ঘন্টাই দিই না কেন। আমার শুরুর আট বছর পরে আমি দেখলাম যে, আচ্ছা গান করে আমি খেতে পারছি। কিন্তু কোনদিন ই আমি বিশ্বাস করি নি আমি যে গান গাই, সে গান করে আমি এই বাজারে টিকে থাকতে পারবো। সেজন্য আমার একটা প্যারালাল প্রফেশন ছিলো। ফ্যামিলির থেকে আমি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছি। স্ট্রাগল করতে হয়েছে তারপরেও আমার ব্যাকআপ ছিলো। আমাকে আমার বাবা কিংবা ভাই কিংবা স্বামী খাবার খরচ দেন নি, আমাকেই দিতে হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে যাত্রাটা। আপনি যেটা বললেন ইন্ডিয়ান মিউজিকের যে প্রাচুর্য, ওদের কালচার টা দেখতে হবে, ওদের উপাসনার মধ্যে সংষ্কৃতি। ওদের ধর্মের অংশ হল সংগীত। ওদের কিন্তু বিরুদ্ধ স্রোতে যেয়ে গান করতে হয় না। আমরাও গান করছি ঠিকই কিন্তু তারপরেও কালে-ভদ্রে আমাদের কে শুনতে হচ্ছে যে "গান করা কি ঠিক?" ওদের মধ্যে এই ডিলেমা নেই।


জেইউডিও : কিন্তু একাত্তরে যখন আমাদের মুক্তির গান গুলো ছিল, তখন তো একটা সম্মিলিত একটা চেষ্টা দেখা গেছে বা ব্যান্ড মিউজিকেও আমাদের অনেক ভাল ভাল ব্যান্ড আছে। আপনার কি মনে হয় কোন সময় থেকে বা হুট করে কোন জিনিসটার কারনে পরবর্তীতে ওই গ্রোথটা আর কন্টিনিউ করলো না? 

সায়ান : হ্যাঁ, আছে, হয়েছে, হয়ে গেছে। কিন্তু এটা কন্টিনিউটি করা, এটার একটা দায়িত্বতার সাথে যাত্রাটা কে অব্যাহত রাখা। সেই জায়গাটা এবং আরেকটা হলো বাজারটাকে আপনি যতই বলেন না কেন, আপনি যদি বাজারের উপরে ছেড়ে দেন আমার গান কেউ শুনবে না। কারন এখানে আপনার কোমর দুলাতে পারবে না। আপনার মন একটু হলেও দুলতে পারে, আপনি ভুরু কুচকে চিন্তা করতে পারবেন যে কি বলছে। আমি অনেক কিছু শুনেছি গান করতে গিয়ে। প্রথম চার পাঁচ বছর হল আমাকে লোকে দেখেছে। দেখেছে, শুনেনি। অদ্ভুত দেখতে একটা জিনিস দেখতে, এটা কি ছেলে নাকি মেয়ে। সারাক্ষণ কালো পড়ে আবার গিটারও বাজায় আবার, বাহ!


জেইউডিও : চুল ছোট ছোট একই সাথে।

সায়ান : হ্যাঁ হ্যাঁ মাউথঅর্গান। আমি কিন্তু খুব ভাল সাংঘাতিক গিটারও বাজাই না আবার মাউথঅর্গানও বাজাই না। কিন্তু আমি আকর্ষণ করতে পেরেছি আমার চুল, আমার জামা, আমার গিটার, আমার হারমোনিকা দিয়ে। আমার কিন্তু ওইটা করার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু ওই কারনে আমি একটা এটেনশন পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি তো গান প্রতিদিন রেওয়াজ করেছি। আমি কষ্ট করে সুর করেছি, আমি কষ্ট করে লিখেছি। সেইখানে এটেনশন প্রথম চার পাঁচ বছর যায় নি। এখন আর লোকে আমাকে ওই প্রশ্নটা আর করে না, খুব কম করে। এখন লোকে বুঝেছে যে আমার রুচির একটা দর্শক তৈরি হয়েছে।  কিন্তু বাজার আমাকে সাপোর্ট করেনি। 


জেইউডিও : এই জন্যই কি আপনার অ্যালবামের সংখ্যা কম?

সায়ান : এই জন্যই আসলে আমার গানের সংখ্যা কম না কিন্তু হ্যাঁ অ্যালবামের সংখ্যা কম। কেননা বাজারে গেলে মানে গত বছর আমার মাত্র একটি গান রিলিজ করলাম। তারপর সেইটার যেই ভিডিওটা বানানো হল সেটার মধ্যে দেখলাম গানের সাথে ভিডিওর কোন সম্পর্ক নেই- সেটার যে ভিডিও সেটা আমি পুরোটা দেখতে পারি নি। তারপর কিন্তু উনারা আমাকে প্রচার ঠিকই করেছেন। বাজারটাই এমন অদ্ভুত ভাবে কাজ করে। আমি উনার বিরুদ্ধে কিছু বলবো না । কিন্তু বলবো যে এই গানটার যেই বিষয় বস্তু সেটার উপযোগী একটি ভিডিও বানানোর মত মানসিকতার লোক এই বাজারে আমি পাইনি। একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে যে "You need to pick your battle", "এই যুদ্ধটা তুমি করতে চাও"। আমি এই যুদ্ধটা করতে চাই না যে কে মিউজিক ভিডিও বানালো, সঠিক করে বানালো ওটার পিছনে তো আমি আমার এনার্জি দিব না। ওই এনার্জিটা আমি দিবো সোশাল এওয়ারনেস তৈরি করে।অন্য জায়গায় গিয়ে আপনার সাথে গল্প করে। মিউজিক ভিডিওর সঙ্গেই আমি একমত না। 

ফটো ক্রেডিটঃ musophia.com

জেইউডিও : যদি নতুনরা আপনার সাথে কাজ করতে চায়, করবেন? 

সায়ান : অবশ্যই করবো। এখন আমি বা আমার ইউটিউব চ্যানেলে বা বিভিন্ন জায়গায় গান হয়ে গেছে অনেক। মানে মেন্টাল হেলথ বা হিউমেন রাইট নিয়ে অনেক গান হয়ে গেছে যেগুলি পাবলিশ করতে চাই। অ্যালবাম থেকে আমি দূরে আছি। কারণ আমি মানুষের সাথে আইকন্টাক্ট হয়ে গান গুলো করছি স্টেজে যেয়ে যেয়ে। সো এটা আমার পথ এবং এটা এই সময়ে এই বাজারের ফেসবুকের আমলেই ঘটছে। এই জন্য আমি খুব আনন্দ নিয়েই করতে পারছি এটা। আমার সমস্যা নেই। 


জেইউডিও : অনেক ক্ষেত্রেই নারী শিল্পীদের আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেখছি না। নতুন নতুন সিঙ্গার যারা আসেন- লিরিকের জন্য, সুরের জন্য হয়ত তাদেরকে কোন সিনিয়র মেল আর্টিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করতে হচ্ছে, তাদের প্রতি নির্ভরশীলতার জায়গা তৈরি করতে হচ্ছে অর্থাৎ নারীদের ওই শক্ত অবস্থানটা আমরা মিউজিকে ভাল ভাবে দেখতে পাই না। এটার কারন আপনি কি মনে করেন?

সায়ান : এইটা বিচ্ছিন্ন না, এটা হল টোটাল পিকচারটার একটা অংশ। ওই শক্ত অবস্থান আপনি অন্য কোথাও পাবেন না। এজ এ ফিল্ম মেকার, এজ এন আর্টিস্ট আপনার ব্যবসা করতে হবে, আপনাকে ছবি আঁকতে হবে, আপনাকে নাটক বানাতে হবে। এজ এ ফিমেল আপনাকে বের হয়ে আসতে হবে। আসলে ফিমেল কথাটাও আমি বলব না, আমি যেটা বলব সেটা হল যে এখন আমি তো আর সিদ্ধান্ত নিয়ে নারী হয়ে জন্মাইনি। আমি ঘটনাচক্রেই নারী হয়ে জন্মেছি, এখন যে সমাজে জন্মেছি সেখানে কিছু অবস্থা চলছে তার ভিতর থেকে আমাকে বের হতে হচ্ছে। তো একজন পারলে সবাই পারবে কিন্তু সহজ না। এটা সত্যি যে এটা একার জার্নি, এটা প্রতিকূল যাত্রা।  কিন্তু আবার এটাও সত্যি কথা যে (নারী হিসেবেও) আপনার ওই ডেসপারেশন লাগবে। যে ঘটনা যাই ঘটুক আমি আমার কাজ করব। যেমন আমি মিলা কে খুব পছন্দ করতাম। কারন মিলাকে যে যাই বলুক মিলা যখন নাচতো, স্টেজে উঠতো ও কিন্তু অশালীন কিছুই করতো না। ও কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্যটা হচ্ছে একটা মেয়ে আর্টিস্ট হিসেবে বাজারের কন্ট্রোল নিয়েছিলো। আমি ওকে স্যালুট করি (কপালে সালাম ঠোকার ভঙ্গিতে)। ও কোমর দুলিয়ে নাচিয়েছে ও কিন্তু ওর জায়গাটা বের করে নিয়েছে, 'I respect her for that' কয়টা মেয়ে পারছে? এত্তো সোজা? আমি চাইলে পারব গিয়ে?


জেইউডিও : নিজস্ব একটা স্টাইল দাঁড় করিয়েছিলেন মিলা...

সায়ান : স্টাইল করেছে সে, এটা তো তার শিল্প। সে শিল্পটা কে কেন আমরা লেবেল করছি এটা অশালীন এটা শালীন! ওতো ওর কাজ করছে। "শিলা কি জাওয়ানী" কি মানুষ দেখছে না?  সমাজকে ওই জায়গাটাতে ম্যাচিউরড হতে হবে। আমাদের সমাজ কিন্তু ম্যাচিউরড না। আমি আশায় আশায় থাকলাম না যে আমাকে সমাজ সহযোগিতা করবে না, আমাকে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষণ করবে না। তাহলে তুমি নিজে একটা চ্যানেল খোলো, তুমি নিজে একটা পেপার তৈরি কর, তুমি নিজে সংগঠিত হও। নিজের কাজটা করে যেতে হবে। আস্তে আস্তে মানুষের মন বদলাবে, কিন্তু প্রত্যেকটা ব্যাপার শুরু হবে আমার এইখান থেকে ৷ আমি যদি না জাগি মা, সকাল হবে না! লতা মঙ্গেশকরের কথা আমি বলতে পারি, নাইনটিন থার্টিজ থেকে এই মহিলা গান করে, ইন্ডিয়ার মতো জায়গায়। She ruled for sixty years! একটা মহিলা, কাপড়টাকে (হাত দিয়ে ইশারা করে) এইভাবে নিয়ে চলতো! কিন্তু she ruled! মেয়েরা করেছে! They were that good.


জেইউডিও : এখনকার তরুণদের চিন্তার জায়গাটায় আপনি যদি এগিয়ে রাখেন, কেন রাখবেন? এই জায়গাটা নিয়ে তারা কিভাবে আরও কাজ করতে পারে, কোনো পরামর্শ?

সায়ান : পরামর্শের স্পর্ধাই আমি করবো না, এক নাম্বার কথা! আমার বয়স বিয়াল্লিশ ৷ আমিও মনে মনে তরুণ!  তারুণ্যকে আমি এগিয়ে রাখি প্রথম কথা হলো যে, তার ভেতরে ঘুণটা এখনও যেতে পারেনি ৷ তারুণ্যের উপদেশের দরকার নেই ৷ তারুণ্যের সাথে- আমার একটা গান আছে এটা নিয়ে, "তোমার নেতা আমার নয় ৷" আমি আসলে তারুণ্যের পক্ষে এই জন্যে, যে আমি "নিরাপদ সড়ক চাই" আন্দোলনের সময় যখন রাস্তায় গেলাম, গানবাজনা করলাম, ওদের সঙ্গে থাকলাম, দেখলাম; অনেক ছিলাম ওদের সঙ্গে— ওরা তো খুব ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস বলে দিচ্ছে না! তারা অত আর্টিকুলেশনের ভেতর দিয়ে গুছিয়ে কথার মারপ্যাঁচের চেয়ে, ঠাস করে একটা সত্যি কথা বলে দেয়! 

'সবাকে' সায়ান

জেইউডিও : অনেকে দাবী করেন, অনুসরণ করার মতো ব্যক্তিত্ব বা আইডিয়াল একটা ক্যারেক্টার এই মুহূর্তে নেই এদেশে। এই ক্ষেত্রে যারা শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী তাঁদের অবদানটা কিরকম হতে পারে ?

সায়ান : আমি তো আসলে একদম উল্টা পথের পথিক, অনেস্টলি স্পিকিং! আমি আইডলে বিশ্বাসই করিনা! আমি ভালোবাসি! আমার চে গুয়েভারাকে দরকার, আমার বঙ্গবন্ধুকে দরকার, আমার রবীন্দ্রনাথকে দরকার, আমার মার্ক্সকে দরকার- আমি তাঁদের কন্ট্রিবিউশনকে সালাম জানাই! তাঁরা তাঁদের সময়ে এসছেন, কিন্তু তাঁরা আমার সময়টাকে দেখেন নি! আমি যেই যুদ্ধটা করছি, সেটার ভিতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু যান নি, রবীন্দ্রনাথ যান নি, চে গুয়েভারা যান নি, মার্ক্স যান নি৷ I know better than them. এটা আমি পরিষ্কার করে বলব যে, যেকোনো অতীতের মহান দেবতা, তারচেয়ে আমার বাস্তবতা কঠিন৷ তাঁর থেকে আমি অনুপ্রেরণা নিবো, কিন্তু আমার তরুণদেরকে আমি বলবো না যে তাঁর মতো হও৷


জেইউডিও : এবার আপনার গানের কথায় আসি ৷ আপনি তো অনেকগুলো গান করেছেন, যদি দুইটা গানের কথা বলতে বলা হয় তাহলে কোন দুইটা গানের কথা বলবেন? আপনার নিজের সবথেকে পছন্দের দুইটা গান...

সায়ান : এরা হলো সন্তানের মত, কারোর প্রতি একটু দুর্বলতা বেশি থাকতে পারে! তার মানে সে আমার বেশি প্রিয় তা নয়৷ আমার একটা গান আছে, "আমার দুঃখগুলো গান হয়ে যায়" ৷ আমার খুউব ব্যক্তিগত সময়ে যখন আমি আমার কোনো ব্যক্তিগত কষ্ট নিয়ে deal করছি৷ এই গানটা আমি টেলিভিশনে কোনদিন গাই-ই নাই! আমার সিরিজে একটা গানের ভেতরে আমি সব ধরতে পারি না৷ ইয়ুথ নিয়ে হোক, উইমেন রাইটস নিয়ে হোক- মেন্টাল হেলথ নিয়ে একটা সিরিজ করছি।


জেইউডিও : আপনি তো গল্প বলেন গানের মধ্যে দিয়ে, সুতরাং সময় দরকার! 

সায়ান : হ্যাঁ৷ একটা গান একটা ছোট ক্যানভাস৷ এমনকি একটা সিনেমাও একটা ছোট ক্যানভাস৷ প্রত্যেকটারই অনেকগুলি ধারাবাহিক মেগা সিরিয়াল (হেসে) চলতে থাকে আর কি! প্রত্যেকটা গান আমার জীবনের একেকটা বেলা৷ একটা গান আছে "আমি গাইছি সবার জন্য" আমার এই গানের মধ্যে আমি বলার চেষ্টা করেছি যে, সবকিছুর জায়গা এই পৃথিবীটা৷ একটা পাখিকে ঐ মর্যাদাই দিতে হবে! একজন পতিতাকে, এবং একজন আসামীকে, ঐ একজন ইহুদীকে, একজন হিন্দুকে- সবাইকে, ঐ মর্যাদাই দিতে হবে৷ আমি ক্রিমিনোলজি পড়েছি আইনে, সাইকোলজি পড়েছি নিজের আগ্রহ থেকে৷ আমার নিজের ফ্যামিলি, আমার নিজের পার্সোনাল জীবনে আমি অনেক কিছু দেখেছি৷ পাঁচ বছর বয়স থেকে আমি আমার মায়ের কাছে থাকি, so I was an abundant child! আমার বাবা চলে গেছেন আমাদেরকে পাঁচ বছর বয়সে রেখে৷ দীর্ঘ সময় আমি তাঁকে ঘৃণা করেছি৷ পরে আমি বুঝেছি যে আচ্ছা, উনি সংসার জীবনটাকে হ্যান্ডেল করতে পারেন নি৷ কিন্তু আমি তো লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছি, আমি তো অনেক কিছু পেয়েছি জীবনে তা আমার বাবার উপর রাগ করে আমি কতদিন বসে থাকবো? ওনার একটা জীবন আছে, ওটা আলাদা! আমার বাবা শুধু আমার বাবা হয়ে জন্মান নি৷ নিজের জীবনটাকেই উনি সামাল দিতে পারেন নি৷ মানুষকে ভালোবাসতে গেলে, তার ইতিহাসকে বাদ দিয়ে ভালোবাসা যায় না! লিগ্যাল পানিশমেন্ট দাও, অভিমান করো, দূরে থাকো, কিন্তু দিনের শেষে নিজে ঐ শাস্তি দিতে গিয়ে ঈশ্বর হয়ে যেও না৷ মানবতা কঠিন! Humanity is a very tough job. এটাই আমার কথা! সবার জায়গায়।


জেইউডিও : আমরা কি একটা গানের রিকোয়েস্ট করতে পারি আপনাকে? আপনি কি শোনাবেন??

সায়ান: বলেন, দেখি! 


জেইউডিও : "ফিরতে ঘরে ভয়"

...মুচকি হেসে গিটার হাতে নিলেন শিল্পী সায়ান।

জেইউডিও : এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া! এতো বেশি ভালোলাগছে যে বলে বোঝাতে পারবো না!! 


সায়ান : না, থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ, আমারও খুব ভালোলাগছে৷ এই ভালো লাগাটা তো সাথে সাথে আমার হয়ে গেলো৷ আপনাদের যেটা ভাল লাগলো, এই যে আপনার হাসিটা! এটা তো আমি পেয়ে গেছি৷ এটা তো আপনি আর নিতে পারবেন না আমার থেকে। গান গাওয়াটাই কিন্তু জীবনে একটা বিরাট পাওয়া৷ গান গেয়ে একটা আরাম লাগে। শোনাতে আরেকটা আরাম লাগে৷ আবার আপনি যখন শুনে আপনার ভেতরে কিছু রিলেট করতে পারেন, সেটা আমাকে বলেন, ধাপে ধাপে শুধু আনন্দ৷ এই যে আপনি বলে গেলেন, আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, গান গেয়ে কি পেলেন- আমি এই কথাটা বলব! যে, অনেক মানুষ এসে আমাকে আমার হাত ধরে বলে, আপনার একটা গান আমি সারারাত শুনেছিলাম; আপনি আমাকে কী দিতে পারেন, একটা মানুষের একটা রাত আমি পেয়েছি! ঐ রাতটা ও আমার সাথে ছিলো। আপনি আমাকে আর কী দিবেন? আপনি আমাকে বাড়ি দিবেন? গাড়ি দিবেন?? আপনি আমাকে প্রথম-আলো পুরস্কার দিবেন?? ঐটা তো আপনার হাসির চেয়ে, আপনার ঐ রাতটার চেয়ে আমার কাছে দামী হতে পারে না! কাজেই, আমি অসম্ভব ধনী একটা মানুষ! I'm very rich!! কারণ মানুষ আমাকে চোখের জল দিয়ে, মুখের হাসি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে৷ আমি খুব ধনী হয়ে বেঁচে থাকি, বেঁচে আছি, এবং আমি খুব ধনী হয়েই বাঁচবো, আপনাদের জন্য! 


জেইউডিও : দোয়া করবেন আমাদের জন্য!

সায়ান : অবশ্যই! ভালো থাকেন, আমার সঙ্গে থাকেন।


(মূল কথোপকথন হতে ঈষৎ সংক্ষেপিত। গল্পের আমেজ ধরে রাখতে যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।) 
https://www.facebook.com/judo2005/
*কপিরাইটঃ জেইউডিও ও জেইউডিও-র প্রকাশনা "সবাক" কর্তৃক সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ